সায়মা কালাম মেঘা ২১ এপ্রিল বিকেলে রাজধানীর কাঁঠালবাগানের ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ৭৪/১ নম্বর ভবনের চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটে ফেইসবুক লাইভে এসে প্রথমে হাত কেটে রক্তাক্ত করেন। তারপর ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে তিনি আত্মহত্যা করেন। এর আগে নিজের হাতে একটি সুইসাইড নোট লিখে যান মেঘা। সুইসাইড নোটে মেঘা লেখেন, “আমি বাঁচতে চাইছিলাম, কিন্তু মাহিবী আর ওর মা আমারে বাঁচতে দেয় নাই। বারবার মাহিবীর কাছে কুত্তার মতো যাই আর ও দিনের পর দিন আমারে পায়ে ঠেলে। ওর মা বোন আমারে যা তা বলে। আব্বু-আম্মু আমারে মাফ কইরা দিও। আমার লাশের আশেপাশেও যেন মাহিবী আসতে না পারে। আল্লাহ মানুষরে মাইয়া দেয়, কিন্তু সবাইরে দেওয়া উচিৎ না। আল্লাহ যাদের অনেক টাকা-পয়সা দেয় শুধু যেন তাদেরই দেয়। তাইলে আমার মতো গরিবের মাইয়া নিয়া ওরা খেলতে পারবে না। আম্মু আমি জানি আমি ছাড়া তোমার কেউ নাই। কিন্তু আমি নিরুপায়। তুমি মুক্তা চাচির কাছে জিজ্ঞাসা কইরা দেইখো আমার পিঠ দেয়ালে ঠেইকা গেছে, তাই আজকে আমি মইরা গেলাম। আমার ভাইটারে মানুষ বানাইয়ো যেন আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারে। আর আব্বুরে সামলাইয়ো, আব্বুরে বুঝাইয়ো আমি নিরুপায় হইয়া করছি।”
ফেইসবুক লাইভে কলেজছাত্রী সায়মা কালাম মেঘার আত্মহত্যার ঘটনায় প্রেমিক মাহিবী হাসানের প্ররোচনার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তবে রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের ওই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার প্ররোচনাকারী হিসেবে মাহিবীর মা, বোন ও বন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে আদালতে দেওয়া অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানিয়েছে পিবিআই। ওই প্রতিবেদনের ব্যাপারে আদালতে আপত্তি জানিয়েছেন মামলার বাদী মেঘার মা রুবিনা বেগম।
২০ নভেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এ প্রতিবেদনটি জমা দেয় পিবিআই। পরে বাদীর আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে আদালত মাহিবী ছাড়াও তার মা সেলিনা নফিজ, বোন নওরিন বন্যা ও বন্ধু সুব্রত দাসের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এরপর আসামিরা আত্মসমর্পণ করলে মাহিবীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে বাকি তিনজনকে জামিন দেয় আদালত। মেঘার মা মামলার বাদী রুবিনা বেগম দেশ রূপান্তরের কাছে অভিযোগ করেন, ‘আমার মেয়ের আত্মহত্যার প্ররোচনাকারী হিসেবে মাহিবী হাসান, তার মা, বোন ও বন্ধু সুব্রত দাস জড়িত। দিনের পর দিন প্রতারণা করে তারা সবাই তাকে আত্মহত্যায় বাধ্য করেছেন। তাই তাদের সবার শান্তি চাই।’
তিনি বলেন, ‘বরিশাল ট্রাফিক পুলিশে মাহিবীর একজন খালু আছেন, যার নাম মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে পিবিআইর চার্জশিট থেকে মাহিবীর মা ও বোনকে বাদ দিয়েছেন।’ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শুক্রবার মোবাইল ফোনে মোস্তাফিজুর রহমান তার বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি পুলিশের একজন এএসআই। আমার স্ত্রীর বড় বোনের ছেলে মাহিবী। তার বাবা ক্যানসারে মারা যাওয়ার পর তাদের পরিবারের অভিভাবক হিসেবে আমি বিষয়টি মীমাংসার জন্য একাধিকবার মেঘার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাই বলে কি আমার পক্ষে পিবিআইর তদন্তে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব?’
এ বিষয়ে পিবিআইর তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক মো. নাছির উদ্দিন বলেন, ‘পিবিআইর তদন্তে কারও প্রভাব বিস্তারের তথ্য জানা নেই। তদন্তবহির্ভূত কোনো পুলিশ কর্মকর্তা এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। সায়মা কালাম মেঘার আত্মহত্যার প্ররোচনাকারী হিসেবে মাহিবী হাসানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু বাকি তিনজনের কারও বিরুদ্ধে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাইনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার দীর্ঘ তদন্তকাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এই মামলার আসামি হিসেবে মাহিবী হাসানের বিরুদ্ধে যেসব তথ্য-প্রমাণ ও সাক্ষ্য পাওয়া গেছে, এখন আদালতে ঠিকমতো সাক্ষীরা হাজির হলে মাহিবীর শাস্তি প্রায় নিশ্চিত।’ জানা গেছে, আত্মহত্যার পর এ ঘটনায় কলাবাগান থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়। কিন্তু মেঘার মা প্রেমিক মাহিবী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে কলাবাগান থানা পুলিশ তা নেয়নি। তাকে ময়নাতদন্তের প্রতিবদনের জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়। কিন্তু হাসপাতালে দুই মাস ঘুরেও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পাননি মেঘার মা।
এরপর গত ২ জুলাই ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন তিনি। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেয়। এরই মধ্যে মাহিবীর খালু পুলিশ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বিভিন্ন কৌশলে মামলা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তাতে কাজ না হলে আসামিরা ২৬ নভেম্বর আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করলে মাহিবীকে কারাগারে পাঠিয়ে তার মা ও বোনকে জামিন দেয় আদালত। পিবিআইর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেঘা ইডেন কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগে অনার্সে পড়তেন। থাকতেন কলাবাগানের একটি ফ্ল্যাটে মুক্তার কাছ থেকে সাবলেটে রুম ভাড়া নিয়ে। মেঘা ও মাহিবীর বাড়ি একই এলাকায়। মৌখিক বিয়ের কথা বলে কলাবাগানের সেই বাসায় তারা স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকতেন। বিয়ের জন্য চাপ দিলে নানা বাহানায় সময়ক্ষেপণের পাশাপাশি মেঘাকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করতে থাকেন মাহিবী। তখন বান্ধবী ও মাহিবীর পরিচিত আফরিন জাহান অনিকার মাধ্যমে তার সঙ্গে কথা বলেন মেঘা। তখন তাকে বিয়ে করবেন বলে ওয়াদা করেন মাহিবী। বিয়ের নির্ধারিত দিনের এক থেকে দেড় মাস আগে মাহিবীর পরামর্শে মেহেদি অনুষ্ঠানের জন্য কেনাকাটা করেন মেঘা।
এছাড়া বান্ধবী অনিকা, মিলি ও ইকরাকে দাওয়াত দেন। মেহেদি অনুষ্ঠানের নির্ধারিত দিনে তারা সবাই কাঁঠালবাগানের ওই বাসায় এসে রাত ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। এ সময় একাধিকবার ফোন করলে মাহিবী আসছেন ও গাড়িতে উঠেছেন- এমন মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে মেঘাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখেন। এ ছাড়া আগেও একবার বিয়ে করবেন বলে মেঘাকে অপেক্ষায় রেখেছিলেন তিনি। বারবার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে বিয়ের দাওয়াত দিয়ে বান্ধবীদের বসিয়ে রেখেও মাহিবীর দেখা পাননি মেঘা। এতে তিনি বান্ধবীদের কাছে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হন। ওই বিষয়টি মাহিবী, তার মা, বোনকেও জানান মেঘা। এরপর সবাই তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন এবং অপ্রীতিকর ভাষায় গালিগালাজ করে তাকে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে বলেন। এরই একপর্যায়ে ২১ এপ্রিল একটি সুইসাইড নোট লিখে মাহিবী হাসানকে ফোন করে আত্মহত্যার কথা জানিয়ে ফেইসবুকে লাইভে এসে আত্মহত্যা করেন তিনি।
পিবিআইর তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিদর্শক নাছির উদ্দিন অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলেছেন, প্রেমিক মাহিবীর দীর্ঘদিনের নিয়মিত অবহেলা, অপমান ও অবজ্ঞার কারণে মেঘা আত্মহত্যা করায় তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯-এর ‘ক’ ধারায় অপরাধ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। তবে বিবাদী সেলিনা নফিজ, নওরিন বন্যা ও সুব্রত দাসের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনার অপরাধ প্রমাণের পক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সূত্র: দেশ রুপান্তর।
পাঠকের মতামত